অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তথ্য গোপনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলামের আদালতে হাজির হয়ে আত্মসমর্পণ করেন
তিনি। এ সময় বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
দুপুর ৩টা ৫ মিনিটে হাজী সেলিম আদালতপাড়ায় হাজির হন। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের দীর্ঘ ভিড় ঠেলে ৩টা ১৫ মিনিটের দিকে এজলাসে আসেন হাজী সেলিম। কিছুক্ষণ পর এজলাসে বসেন বিচারক। প্রথমে হাজী সেলিমের আইনজীবী ৩টি আবেদনের বিষয়ে শুনানি শুরু করেন। তিনি আদালতকে বলেন, সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের একটি মামলায় তাকে দণ্ড দেয়া হয়েছে। এই মামলায় তাকে জামিন দেয়ার মতো বহু গ্রাউন্ড রয়েছে। আমরা তার জামিন চাই। দুই. জামিন দেয়া না হলে কারাগারে তার ১ম শ্রেণির ডিভিশন মর্যাদা চাই।
তিন. তিনি যেহেতু অসুস্থ তাই তাকে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা করার জন্য অনুমতি দেয়া হোক। জবাবে দুদকের আইনজীবী এডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, দুদকের কোনো মামলায় ১০ বছরের সাজা হলে তাকে জামিন দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমরা তার জামিনের বিরোধিতা করছি। তবে জেলকোড অনুযায়ী ডিভিশন ও চিকিৎসার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোনো কিছু বলার নেই। আদালত চাইলে দিতে পারেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করেন। তবে জেলকোড অনুযায়ী ডিভিশন ও চিকিৎসা প্রদানের নির্দেশ দেন।
আদালত লিখিত আদেশে যা বলেন: সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাজী মোহাম্মদ সেলিম হাইকোর্টের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করে জামিনের দরখাস্ত দাখিলপূর্বক আপিল দায়েরের শর্তে জামিনের প্রার্থনা করেন। পৃথক পৃথক দরখাস্ত দাখিল করে কারাগারে ১ম শ্রেণির মর্যাদা প্রদানের ও কারাগারের তত্ত্বাবধানে দেশের উন্নতমানের হাসপাতালে ব্রেটার ট্রিটমেন্টের আদেশ প্রার্থনা করেন। জামিন বিষয়ে আসামিপক্ষ ও দুদকের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। নথি পর্যালোচনা করে বিচারক আদেশে বলেন, হাইকোর্ট ডিভিশন ক্রিমিনাল আপিল ৩৫৩৭/২০০৯নং মামলায় আদালত কর্তৃক বিশেষ ৭/২০০৮নং মামলায় আসামির ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ বহালসহ তার বিষয়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের আদেশ প্রদান করেন। যেহেতু আসামি ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, সেহেতু আসামিকে জামিন প্রদান সঙ্গত মনে করি না। ফলে আসামির জামিন প্রার্থনা নামঞ্জুর করা হলো। সাজা ভোগের নিমিত্তে সাজা পরোয়ানা মূলে আসামিকে কারাগারে প্রেরণ করা হোক। এছাড়া আসামিকে কারাগারে ১ম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান ও উন্নত চিকিৎসা প্রদান বিষয়ে দুই পক্ষের বক্তব্য শোনেন। দরখাস্তকারী আসামির দাবি মতে আসামি একজন সংসদ সদস্য এবং ভালো চরিত্রের অধিকারী, তার সামাজিক মর্যাদা, আসামি যে অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন তার ধরন ইত্যাদি বিবেচনায় তাকে জেলকোড অনুযায়ী ১ম শ্রেণির ডিভিশন প্রদান কিংবা উন্নতমানের চিকিৎসা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ প্রদান করা হলো। আদেশের কপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর প্রেরণ করা হোক।
শুনানিতে আদালতের কাঠগড়ায় হাজী সেলিম ছিলেন নীরব। এজলাসের ভিড় কমাতে তিনি নিজেই হাতের ইশারায় বের হয়ে যেতে বলেন। পরে তারা কোর্ট থেকে বের হয়ে যান। শুনানি শেষে তিনি এজলাসের ভিতরে বেঞ্চের উপরে শুয়ে পড়েন। বিকাল ৫টার পর হাজী সেলিমকে নিয়ে পুলিশের পিকআপ ভ্যানটি কারাগারের উদ্দেশে রওনা করে। আদালত চত্বরে প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সদস্যরা জানান, আদালতের এজলাস ছেড়ে বাইরে বের হতেই বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের মাঝে পড়ে যান তিনি। ভিড় ঠেলে সামনে যেতে পারছিলেন না। পরে পুলিশ ভ্যানে করেই কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এর আগে দুপুর থেকে আদালত চত্বরের রেবতী ম্যানশনের সামনে তার সমর্থকরা অবস্থান নেন। হাজী সেলিম আদালত চত্বরে প্রবেশ করলে নেতাকর্মী, বিভিন্ন ওয়ার্ড কমিশনার ও তার আইনজীবীরা তার পক্ষে স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে থাকেন। এছাড়াও তার আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ, আইনজীবী, পুলিশ, সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় আদালতপাড়ায়। যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি এড়াতে আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বাড়ানো হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি। আদালতপাড়ার প্রধান ফটক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন তারা।
দুই যুগ আগের একটি মামলায় হাজী সেলিমের ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে হাইকোর্ট তাকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। সে অনুযায়ী ঈদের পর তিনি আত্মসমর্পণ করবেন বলে তার আইনজীবী জানান। কিন্তু ঈদের আগে ২রা মে তিনি থাইল্যান্ডে গেলে নানামুখী আলোচনা শুরু হয়। পরে ৫ই মে তিনি থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরেন। সেদিন তার আইনজীবী জানান, ১৬ই মে বা তার কাছাকাছি সময়ে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন হাজী সেলিম। এরপর ২৫শে মে আত্মসমর্পণ বরবেন বলে জনান তার আইনজীবী। অবশেষে তিনদিন আগেই আত্মসমর্পণ করলেন হাজী সেলিম। এ ব্যাপারে তার আইনজীবী বলেন, আমার মক্কেল আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ায় তিনদিন আগেই আত্মসমর্পণ করেছেন। দুই একদিনের মধ্যেই এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবো।
চলতি বছরের ৯ই ফেব্রুয়ারি অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেয়া ১৩ বছরের কারাদণ্ড কমিয়ে ১০ বছর বহাল রাখার রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। ২০০৭ সালের ২৪শে অক্টোবর জরুরি অবস্থার সময় হাজী সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ২৭শে এপ্রিল বিচারিক আদালতের রায়ে তাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে ২০০৯ সালের ২৫শে অক্টোবর হাজী সেলিম এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০১১ সালের ২রা জানুয়ারি হাইকোর্ট ১৩ বছরের সাজা বাতিল করে রায় দেয়। হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করে দুদক। সে আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ই জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। একইসঙ্গে হাইকোর্টে ওই আপিল পুনরায় শুনানি করতে বলা হয়। এরপর প্রায় পাঁচ বছর ওই আপিলের শুনানি হয়নি। এরই ধারাবাহিকতায় আপিলটি শুনানির উদ্যোগ নেয় দুদক। ২০২০ সালের ১১ই নভেম্বর হাইকোর্ট বিচারিক আদালতে থাকা মামলার যাবতীয় নথি (এলসিআর) তলব করেন। কয়েক দিবস শুনানি শেষে আপিলটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়। এরপর গত বছরের ৯ই মার্চ হাইকোর্টের বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করেন।