দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ৯২ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শতভাগ রপ্তানিপণ্য যায় ১৯টি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি বা অফডক) মাধ্যমে। এসব আইসিডি মূলত বন্দরের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার জট কমাতে এবং পরিচালনা স্বাভাবিক রাখতেই ১৯৯৫ সাল থেকে এসব ডিপো কাজ করছে।
ডিপো পরিচালনায় সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি নীতিমালা করেছিল। এরপর ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ২০২১ সালে এনবিআর আবার নীতিমালা প্রণয়ন করে। অফডক মালিকরা নীতিমালা অনুসরণ করে পরিচালনার দাবি করলেও যন্ত্রপাতি সংকটসসহ নীতিমালা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। আর অভিযোগ আনা হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
অবশ্য তাদের মতে, ডিপোগুলো নীতিমালা মেনেই চলছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ নীতিমালা অনুযায়ী, বিপজ্জনক ও বিস্ফোরক জাতীয় মালামাল কনটেইনার / সংরক্ষণ ও হ্যান্ডলিংয়ের ক্ষেত্রে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ডেঞ্জারাস গুডস’ (আইএমডিজি) নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ প্রত্যেক বেসরকারি ডিপোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় পণ্যাগার (ওয়্যার হাউস) নির্মাণ করতে হবে। পাশে পানির ব্যবস্থা ও পণ্যাগার দেয়ালে ঘেরাও করতে হবে। থাকতে হবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের
ব্যবস্থাও। কনটেইনারের গায়ে পণ্যের ক্যাটাগরি অনুযায়ী সাংকেতিক চিহ্ন দেওয়া স্টিকার লাগাতে হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ১৯টি ডিপোতে এ ধরনের পণ্যাগার নেই।
ডিপো মালিকরা বলছেন, বিস্ফোরক-জাতীয় পণ্য রপ্তানি হওয়ার সুযোগ নেই। আমদানি হলে সেগুলো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সরাসরি কারখানায় নেওয়া বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া রাসায়নিক পণ্য ১ শতাংশেরও কম রপ্তানি হওয়ায় ব্যয়বহুল পণ্যাগার নির্মাণ করেননি। তবে প্রয়োজন হলে আগামীতে নির্মাণের বিষয়ে তারা একমত।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, ‘দরকার মনে করিনি, তাই এ ধরনের বিশেষ পণ্যাগার নির্মাণ করিনি। এখন প্রয়োজন হলে করব। সেটি আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছি।’
১৫ বছর ধরে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রপ্তানি হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কখনো তো সমস্যা হয়নি। আন্তর্জাতিক তিনটি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা অফডকগুলো সার্টিফাইড। এগুলো কমপ্লায়েন্স না হলে এখান থেকে বিদেশি ক্রেতারা পণ্য নিতেন না।’
বাংলাদেশের উন্নয়নে একটি পক্ষ খুশি হতে পারে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘একটি বিশেষ মহল সবসময় পানি ঘোলা করতে চায়। পদ্মা সেতুর আগে এ ধরনের ঘটনার কারণও খতিয়ে দেখতে হবে। অর্থাৎ নাশকতা কিনা সেটি তদন্ত করতে হবে।’
গত শনিবার রাতে সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়িতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে গতকাল পর্যন্ত ৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়ে চিকিৎসাধীন আছে প্রায় দেড় শতাধিক মানুষ। ডিপোতে রাখা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটে।
এদিকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বিস্ফোরণ বা বিপজ্জনক বস্তু নয় বলে দাবি করেছেন বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসাইন। অফডকগুলো বিস্ফোরক দপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেসরকারি ডিপোর পরিচালনার জন্য বিস্ফোরক ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই। তারা এনবিআর ও নৌ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে। বিএম ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বিস্ফোরণ ঘটলেও সেগুলো বিস্ফোরক বা বিপজ্জনক পদার্থ নয়। বিস্ফোরক মজুদ করলে তখন ছাড়পত্র লাগে।
নীতিমালা অনুযায়ী ডিপোগুলো পরিচালিত হচ্ছে জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, আন্তর্জাতিক আইএসপিএস কোড অনুযায়ী ডিপোগুলো চলছে। ডিপোর কার্যক্রম দেখভাল করতে কাস্টমস, বন্দর, চট্টগ্রাম চেম্বার, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিনিধির সমন্বয়ে মনিটরিং কমিটি রয়েছে। কমিটি নিয়মিত অডিট করে। একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম।
বিকডার সচিব রুহুল আমীন শিকদার জানান, গ্লোবাল সিকিউরিটি ভেরিফিকেশন (জিএসভি) প্রতি বছর ডিপোগুলো অডিট করে। এ জন্য ওই প্রতিষ্ঠানকে এক হাজার ডলার দেওয়া হয়। তাদের দেওয়া অডিট রিপোর্ট অনুসারে নম্বর দেওয়া হয়। সেই নম্বর অনুযায়ী অফডকগুলোর অবস্থা উঠে আসে। বিদেশি ক্রেতা ও শিপিং কোম্পানিগুলো মার্কিং অবস্থান দেখেই ডিপো ব্যবহার করে।
তিনি আরও বলেন, ‘কেমিক্যাল মজুদের জন্য আলাদা পণ্যাগার নেই। কারণ এগুলো কারখানা থেকে জারে করে সিল্ড অবস্থায় আছে। ট্রাক থেকে সেগুলো আমরা কনটেইনারে ভরে জাহাজে পাঠাই। কোনো ডিপো রপ্তানিপণ্য চেক করতে পারে না। কেমিক্যাল নিয়মিত রপ্তানি পণ্য নয়, এই পণ্যের জন্য সব ধরনের অনুমোদন রপ্তানিকারক নিয়ে থাকে।’